কোন ভিটামিনের অভাবে গা ঘামে? সহজ ভাষায় জেনে নিন কারণ ও সমাধান!
গরমে একটু ঘাম হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ভাবুন তো এমন অবস্থা: ঠাণ্ডা ঘরে বসে আছেন, তবুও গা থেকে টপ টপ করে ঘাম পড়ছে। সামান্য কাজ করলেই শার্ট ভিজে যাচ্ছে। বিশেষ করে মাথা, ঘাড়, হাত-পা বা বগলে অস্বস্তিকর পরিমাণে ঘাম হচ্ছে। আপনার কি এমন হয়?
অনেকেরই হয়! আর আমরা ভাবি, "গরম লাগছে নাকি?" কিন্তু জানেন কি, শরীরে কিছু ভিটামিন বা খনিজের অভাব ও এই অতিরিক্ত ঘামের জন্য দায়ী হতে পারে? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন! আজকের এই লেখায়, খুব সহজ ভাষায় জেনে নেব কোন কোন পুষ্টির ঘাটতির কারণে গা ঘামতে পারে, এর পাশাপাশি অন্যান্য সম্ভাব্য কারণ এবং কী করবেন সে সম্পর্কেও বলব।
ঘাম হওয়া শরীরের একটা দারুণ প্রাকৃতিক সিস্টেম। এর মূল কাজ হলো শরীরকে ঠান্ডা রাখা। আমরা যখন কাজ করি, গরমে থাকি বা একটু উত্তেজিত হই, তখন শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এই বাড়তি তাপ বের করে দিতেই ঘাম হয়। শরীরের ভেতরের এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের নার্ভাস সিস্টেমের একটা বিশেষ অংশ। আর এই নার্ভ সিস্টেম ঠিকমতো চালাতে চাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও মিনারেল। যখন সেগুলোর অভাব হয়, তখন এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় গোলমাল দেখা দিতে পারে, ফলস্বরূপ – অহেতুক বা অতিরিক্ত ঘাম!
কোন কোন ভিটামিন বা খনিজের অভাব গা ঘামাতে পারে?
একটা কথা আগেই বলে নিই, শুধু ঘাম দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব নয় যে আপনার অমুক ভিটামিনের অভাব। তবে, কিছু ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি এই সমস্যার সাথে জড়িত থাকতে পারে। আসুন জেনে নেই সেগুলো:
১. ভিটামিন ডি (সূর্যের ভিটামিন):
ভিটামিন ডি শুধু হাড় গঠনেই সাহায্য করে না, এটা আমাদের নার্ভ সিস্টেমকে ঠিক রাখতেও খুব জরুরি। নার্ভ সিস্টেম ঠিক না চললে ঘাম নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা হয়।
ভিটামিন ডি-র অভাব হলে শুধু ক্লান্তি বা হাড়ে ব্যথাই হয় না। অনেক সময় মাথা ও ঘাড়ে অস্বাভাবিক রকমের ঘাম হতে পারে। বিশেষ করে যখন খুব গরমও লাগছে না, তবুও ঘামছে।
মূল কারণ হলো রোদের অভাব। আমরা এখন ঘরে বসে কাজ করি, বাইরে কম বের হই। তাছাড়া খাবারে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি না থাকাও একটা কারণ।
এই অভাব পূরণ করতে:
- সকাল ৮টা-১০টার দিকে হালকা রোদে ১৫-২০ মিনিট হাত-পা খোলা রেখে বসুন (সানস্ক্রিন লাগাবেন না)।
- খাবারের মধ্যে চর্বিযুক্ত মাছ (ইলিশ, পাঙাশ, টুনা), ডিমের কুসুম, গরুর কলিজা, ফর্টিফায়েড দুধ বা দই খান।
২. বি ভিটামিন (বিশেষ করে B1 ও B12):
বি ভিটামিনগুলো শরীরের শক্তি তৈরিতে আর নার্ভ সিস্টেম চালানোর জন্য দারুণ জরুরি। এর মধ্যে দুটোর অভাব ঘামের সাথে সরাসরি যুক্ত:
ভিটামিন বি১ (থায়ামিন):
ভিটামিন বি১ খাবার থেকে শক্তি বের করে আনে এবং নার্ভের কার্যকারিতা ঠিক রাখে।
এর অভাব হলে ক্লান্তি, খিটখিটে মেজাজ, পায়ে ঝিনঝিন বা জ্বালাপোড়া করার পাশাপাশি অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
অভাবের কারণ হতে পারে অতিরিক্ত চাল-আটা (পলিশ করা) খাওয়া, বেশি মদ্যপান, কিডনির সমস্যা।
এই ভিটামিন পাবেন ঢেঁকিছাঁটা চাল (লাল চাল), ওটস, বিভিন্ন ধরনের ডাল (মসুর, মুগ, ছোলা), বাদাম (চিনাবাদাম), বীজ (সূর্যমুখী), শুকনো মটরশুঁটিতে।
ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন):
ভিটামিন বি১২ রক্তকণিকা তৈরি করে এবং নার্ভকে সুস্থ রাখে।
এর অভাব হলে দুর্বল লাগা, হাঁপ ধরা, হাত-পা ঝিনঝিন করা, মনে রাখতে না পারার পাশাপাশি অনেক সময় অতিরিক্ত ঘামও হতে পারে।
অভাবের প্রধান কারণ মাছ-মাংস-ডিম-দুধ কম খাওয়া (বিশেষ করে যারা একদম নিরামিষ খান)। পাকস্থলীর কোনো রোগ থাকলেও (যেমন গ্যাস্ট্রাইটিস) এই ভিটামিন ঠিকমতো শোষণ হয় না।
ভিটামিন বি১২ পাবেন মাছ (সরপুঁটি, কাতলা, ট্যাংরা), মাংস (গরু, খাসি, মুরগি), ডিম, দুধ, দই, পনিরে। নিরামিষাশীরা ডাক্তারের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নিতে পারেন।
৩. ক্যালসিয়াম (শুধু হাড়ের জন্য নয়!):
ক্যালসিয়াম নাম শুনলেই আমরা হাড়ের কথা ভাবি। কিন্তু এটা পেশী সংকোচন-প্রসারণ এবং নার্ভ থেকে বার্তা পাঠানোর জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঘাম নিয়ন্ত্রণে নার্ভের বার্তা ঠিকমতো পৌঁছানো দরকার।
এর অভাব হলে পেশিতে টান পড়া, আঙুল বা ঠোঁট ঝিনঝিন করা, দাঁতের সমস্যার পাশাপাশি অতিরিক্ত ঘামও হতে পারে।
অভাবের কারণ হতে পারে ভিটামিন ডি-র অভাব (ভিটামিন ডি ছাড়া ক্যালসিয়াম শোষণ হয় না), দুধ-দই কম খাওয়া, বা কিছু হরমোনের সমস্যা।
ক্যালসিয়াম পাবেন দুধ, দই, পনির, ছোট মাছ (মলা, ঢেলা, কাঁটাসহ খাওয়া যায়), সবুজ শাক (পালং শাক, কলমি শাক), তিল, বাদামে।
৪. ম্যাগনেসিয়াম (শান্তির খনিজ):
ম্যাগনেসিয়াম শরীরের প্রায় ৩০০টিরও বেশি বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। এটা পেশী ও নার্ভকে শিথিল করে, ঘুম আনতে সাহায্য করে এবং ঘামের গ্রন্থির কাজেও ভূমিকা রাখে।
এর অভাব হলে পেশিতে টান বা ব্যথা, ঘুম না আসা, মাথাব্যথা, অস্থির লাগা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
অভাবের কারণ হতে পারে প্রক্রিয়াজাত খাবার (প্যাকেটজাত, ফাস্ট ফুড) বেশি খাওয়া, অতিরিক্ত চাপ বা দুশ্চিন্তা, ডায়াবেটিস, বা কিছু পেটের অসুখ।
ম্যাগনেসিয়াম পাবেন কলা, সবুজ শাকসবজি (পালং, লাউশাক), বাদাম (কাজু, আমন্ড), বীজ (কুমড়ার বীজ, তিসি), ডার্ক চকোলেট (৭০%+ কোকো), ডাল, গোটা শস্য (যেমন ওটস), আভোকাডোতে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা (একটু মন দিয়ে পড়ুন!)
১. ভিটামিন/খনিজের অভাবই একমাত্র কারণ নয়:** মনে রাখবেন, অতিরিক্ত ঘামানোর পেছনে আরো অনেক বড় কারণ থাকতে পারে। যেমন:
- থাইরয়েড হরমোন বেশি হওয়া (হাইপারথাইরয়েডিজম):** এটা খুবই কমন একটা কারণ। শরীরের মেটাবলিজম বেড়ে যায়, গরম লাগে, ঘাম হয়।
- ডায়াবেটিস: রক্তে শর্করা কমে গেলে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) প্রচুর ঘাম হতে পারে।
- মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি: হট ফ্ল্যাশের সময় হঠাৎ করে গরম লাগে ও ঘাম হয়।
- অনেক জ্বর বা সংক্রমণ: শরীর সংক্রমণের সাথে লড়াই করলে ঘাম হয়।
- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা প্যানিক অ্যাটাক: মানসিক চাপের কারণেও ঘাম হতে পারে।
- কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: যেমন ব্যথানাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, কিছু মানসিক রোগের ওষুধ।
- "প্রাইমারি হাইপারহাইড্রোসিস": এটা একটা নির্দিষ্ট সমস্যা, যেখানে শুধু ঘামের গ্রন্থিগুলোই অতিসক্রিয়। এর জন্য কোনো রোগ দায়ী নয়।
২. নিজে নিজে ডাক্তারি করবেন না! শুধু ঘাম দেখে ভেবে নেবেন না যে, "আমার ভিটামিন ডি কম, আমি ক্যালসিয়াম খাব।" এটা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। আপনি হয়তো ভুল করছেন, আর ভেতরে ভেতরে অন্য কোনো বড় সমস্যা বাড়তে পারে!
৩. ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই হবে: অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা হলে, যত দ্রুত সম্ভব একজন পারিবারিক চিকিৎসক (জিপি) বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে যান। তিনি আপনার লক্ষণগুলো শুনে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবেন। যেমন রক্ত পরীক্ষা (CBC, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, থাইরয়েড হরমোন - TSH, Free T3, T4, রক্তের শর্করা ইত্যাদি)। অন্য কোনো লক্ষণ থাকলে তার উপর ভিত্তি করে আরো টেস্ট দিতে পারেন। সঠিক কারণ জানা গেলেই কেবল সঠিক চিকিৎসা সম্ভব!
অতিরিক্ত ঘাম কমাতে যা করবেন
১. ডাক্তারের কথা শুনুন: তিনি যদি কোনো রোগ শনাক্ত করেন (যেমন থাইরয়েড বা ডায়াবেটিস), সেটার চিকিৎসা নিয়মিত করুন। তিনি যদি ভিটামিন/খনিজের ঘাটতি পেয়ে সাপ্লিমেন্ট দেন, সেটা ঠিকমতো খান। কোনো সাপ্লিমেন্ট নিজে থেকে শুরু করবেন না!
২. খাবারের দিকে নজর দিন (সুষম আহার): শরীরের প্রয়োজন মেটাতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সবচেয়ে ভালো উপায়।
- রোজ কিছুটা সময় রোদে কাটান: ভিটামিন ডি-র জন্য সকালের হালকা রোদ জাদুর মতো কাজ করে।
- প্রচুর শাকসবজি ও ফল খান: এতে ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবার থাকে।
- গোটা শস্য খান: লাল চালের ভাত, ওটস, আটার রুটি।
- প্রোটিন রাখুন: মাছ, মুরগি, ডিম, দুধ, দই, ডাল, বাদাম নিয়মিত খান।
- চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমিয়ে দিন: এগুলো পুষ্টি কমায় এবং সমস্যা বাড়াতে পারে।
৩. জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনুন:
- সুতি কাপড় পরুন: নাইলন বা পলিয়েস্টারের চেয়ে সুতি কাপড় ঘাম শুষে নেয় এবং বাতাস চলাচল করতে দেয়। হালকা রঙের জামা পরুন।
- এন্টিপারস্পিরেন্ট ব্যবহার করুন: ঘাম কমাতে বিশেষ করে বগল, হাত-পায়ে কাজে আসতে পারে। রাতে ঘুমানোর আগে শুকনো ত্বকে লাগালে ভালো ফল পাবেন। তবে অতিরিক্ত ব্যবহারে ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে।
- মানসিক চাপ কমাতে শিখুন: দুশ্চিন্তা বাড়লে ঘামও বাড়ে। তাই দৈনিক কিছু সময় যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা গভীর শ্বাসের ব্যায়াম করুন। যা ভালো লাগে (গান শোনা, বই পড়া, বাগান করা) তাই করুন।
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন: ঘামের সাথে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। তাই পানি খেয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করুন। ডাবের পানি, লেবুর পানি, ঘরে বানানো স্যালাইনও ভালো।
- ধূমপান ও মদ্যপান বাদ দিন: এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ঘামের সমস্যাও বাড়াতে পারে।
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন ও ঝাল-মসলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন: চা-কফি কম খান। অতিরিক্ত ঝাল খাবার খেলে ঘাম বাড়তে পারে।
শেষ কথা: ঘাম নিয়ে ঘাবড়াবেন না, সচেতন হোন
অতিরিক্ত ঘাম হওয়া সত্যিই বিব্রতকর এবং অস্বস্তিকর একটা সমস্যা। ভিটামিন ডি, বি ভিটামিন (বিশেষ করে B1 ও B12), ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের অভাব এই সমস্যার পেছনে একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। সুষম খাবার খাওয়া এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই ঘাটতি পূরণে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
কিন্তু, সবচেয়ে বড় কথা: এই লেখা শুধু আপনাকে সচেতন করতেই। এটা কোনো চিকিৎসা পরামর্শ নয়। আপনার ঘামের সমস্যা যদি অস্বস্তি তৈরি করে, যদি মনে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, তাহলে **অবশ্যই অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।** কারণটা সঠিকভাবে জানাটাই প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণটা জানলে সমাধানও সহজ হয়।
সুস্থ থাকুন, পুষ্টিকর খাবার খান, আর চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন!
সৌমিক আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url